হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে
বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দ্বীন
(অর্থাৎ দ্বীনের বিধি-বিধান ও এর বিভিন্ন পন্থা) অত্যন্ত সহজ সরল। কিন্তু
যে ব্যক্তি দ্বীনের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করবে সে পরাজিত হবে।
তাই সবার
কর্তব্য হবে, সঠিকভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে ইসলামের নির্দেশিত পথ অবলম্বন করে
বাড়াবাড়ি না করে ধীর স্থিরভাবে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে চলা এবং আল্লাহর
রহমত ও করুনার আশা পোষণ করা এবং সকাল-বিকেল ও শেষরাতে নফল এবাদত দ্বারা
অধিক নৈকট্য লাভ ও উন্নতির পথে সাহায্য গ্রহণ করা। বোখারি, প্রথম
খণ্ড,হাদিস নম্বর-৩৫।
ইসলাম সহজ, সরল ও সত্য ধর্ম। সাম্যের ধর্ম।
বিভেদ ভুলে এক হয়ে চলা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। কিন্তু সেই সাম্যে, সহজ, সরল
ও সত্য ধর্মে আজ নানা মতের ছড়াছড়ি। যে যেই মতের তার কাছে সেই মতই সঠিক।
বাকি সব মতই ভুল। আর এই কারণেই এতো অসহিষ্ণুতা। সবাই বুঝে না বুঝে ইসলাম
রক্ষায় ব্যস্ত। আর এই ইসলাম রক্ষা করতে গিয়ে কে হকের ওপর অবস্থিত তা
প্রতিষ্ঠা করতেই সবাই ব্যস্ত। কিন্তু আমলের খবর নেই। হযরত মুয়াবিয়া ইবন আবু
সুফিয়ান(রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম
বলেছেন, জেনে রাখো! তোমাদের আগে আহলে কিতাবগণ (ইহুদি ও নাসারা) বাহাত্তর
দলে বিভক্ত হয়েছে। আর এ মিল্লাতের লোক অদূর ভবিষ্যতে তিহাত্তর দলে বিভক্ত
হবে। এক ফিরকা হবে জান্নাতি, আর তারা ওই জামাতভুক্ত যারা আল্লাহর কিতাব ও
রাসুলের সুন্নতের অনুসারী হবে। দাউদ সরিফ,হাদিস নম্বর-৪৫২৮।
যারা
তথাকথিত মতবাদ নিয়ে ব্যস্ত তারা সবাই হয়তো এই হাদিস সম্পর্কে জানেন। কিন্তু
তাদের কারো সময় নেই একটু কোরআন পড়ার। একটি হাদিস পড়তে হয়তো এক মিনিটের
বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু সেই এক মিনিট সময়ও কারো নেই। কিন্তু “বিদাত”,
‘‘এই লোক কাফের হয়ে গেছে”, ‘‘এর নামাজ হয় না”, ‘‘এর ঈমান নেই”, ‘‘এইটা
শরিয়ত বিরুদ্ধ”, ‘‘এইটা করতে হবে”, ‘‘ওইটা করতে হবে” ইত্যাদি ইত্যাদি এই
শব্দগুলো তারা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন। যে যতো জোরে এই শব্দগুলো বলতে
পারেন তিনি ততো বেশি সাহসী ও ইসলাম রক্ষায় নিজেকে উৎসর্গীকৃত মনে করেন।
অনেকটা দাউদ শরীফের ৪৫২৮ নম্বর হাদিসে বর্ণিত রাবি ইয়াহইয়া এবং আমর (রা.)
এর বর্ধিত অংশ “আমার উম্মতের মধ্যে অদূর ভবিষ্যতে এমন এক দল লোক সৃষ্টি
হবে, যাদের মধ্যে গোমরাহি এভাবে বিস্তার লাভ করবে যেন ক্ষিপ্ত কুকুরের
কামড়ানোর ফলে সৃষ্ট রোগ (যা রোগীকে পাগল বানিয়ে দেয়)” এর মতো।
কিন্তু
সেই লোকটিকেই যদি বলা হয় আপনি এই মাত্র যেই কথাটি বললেন তার সপক্ষে
কোরআন-হাদিসের ভিত্তিতে দলিল দিন বা প্রমাণ করে দিন আপনি যা বললেন তা সঠিক।
তখন দেখা যাবে বেশিরভাগই উত্তর দেবে না। আর যারাও বা দেবেন তারা সেই
উত্তরটাই দেবেন, যেটা তার ওস্তাদ বলেছেন বা যাকে অনুসরণ করে তার কোনো বই বা
ওয়াজ। মনে রাখতে হবে ইসলাম কোনো ওয়াজ বা বই বা মতোবাদ নির্ভর ধর্ম নয়।
এখানে একটি কথাকে মনে রাখতে হবে উত্তেজিত হওয়ার আগে যে আমি যে বিষয় নিয়ে
উত্তেজিত তা সম্পর্কে আমি জানি কি না? কোরআন-হাদিসের ভিত্তিতে আমার সে
জ্ঞান আছে কি না? আনাছ(রা.) হতে বর্ণিত, আমরা খলিফা ওমর (রা.) এর কাছে
উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন, কোনো বিষয়ে অযথা বাড়াবাড়ি করতে আমাদের (নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরফ থেকে) নিষেধ করা হয়েছে।
বোখারি,সপ্তম খণ্ড,হাদিস নম্বর-২৬৯৫।
করজোড়ে নিবেদন ও অত্যন্ত
সম্মানের সঙ্গে নিবেদন তাদের কাছে যারা এই জাতীয় কাজগুলো করেন তারা যেন আর
এই জাতীয় কাজগুলো না করেন। কারণ এটা তো সত্য যে যিনি অন্যকে ভুল মনে করে
উত্তেজিত তিনি যেমন মুসলমান তেমনি যাকে ভুল মনে করলেন তিনিও মুসলমান।
দু’জনেই নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত সব আমলই করেন এক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
সেক্ষেত্রে দু’জনই মহানবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের
এই কথাটি স্মরণ রাখবেন যা তিনি রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে দেওয়া ইসলামের
দাওয়াতের চিঠিতে লিখেছিলেন। তিনি বলেন, একটি কথার দিকে আস, যা আমাদের ও
তোমাদের মধ্যে সম্পূর্ণ সমান, তা এই যে আমরা আল্লাহ ব্যতিত আর কারো বন্দেগি
করবো না। পবিত্র কোরআনে সুরা আনআমে এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর কঠোর সতর্ক
বাণীর মাধ্যমে তাঁর রাসুলকে বলেছেন, যারা দ্বীনে বিভিন্ন মতের উদ্ভব
ঘটিয়েছে, বিভক্ত হয়েছে দলে দলে, তাদের কোনো দায়িত্ব তোমার নেই, তাদের
ব্যাপার আল্লাহর হাতে, পরে আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের বিষয়ে জানিয়ে
দেবেন।আয়াত-১৫৯।
তাই যখনই কারো কোনো ধর্মীয় বিষয়ে সন্দেহের উদ্রেক
হবে বা কারো কোনো কাজ ভুল মনে হবে তখন তাকে উগ্রতা দিয়ে নয় বরং শান্তভাবে
বুঝিয়ে বলতে হবে। অথবা দু’জনের মনোনীত কোনো আলেম বা নিজেরা পড়ে একজন
আরেকজনকে প্রমাণসহ বুঝিয়ে দিতে হবে যে তোমার কাজটা ভুল। অন্যথায় সবাই
নিজেকে সঠিক মনে করলে সমাজের এই সব ধর্মীয় সমস্যা কখনোই যাবে না। ফিতনা
ব্যাপক আকার ধারণ করবে। সমাজে দাঙ্গা বাধবে। এক মতপন্থি অন্য মতপন্থিকে
বিদাতি মনে করে মারামারি কাটাকাটিতে লেগে যাবে। আর তাদের দেখে অন্য যারা
কোনো মতপন্থি না বা শান্তিপ্রিয় বা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পায়রবি করে, রোজা
পালন করে, জাকাত দেয়, সামর্থ্য থাকলে হজ করে, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি
অর্জনে ব্যস্ত তারা বিভ্রান্ত হবে। ইসলামে বাড়াবাড়ি বা উগ্রতার কোনো স্থান
নেই।
আর এই বিষয়টির জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো কোরআন বুঝে পড়া। কোরআন
একটি সম্পূর্ণ জীবন বিধান। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম
বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর মহাগ্রন্থ রেখে গেলাম,
যদি তোমরা একে সুদৃঢ় রূপে ধরে থাক তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। প্রতিদিন যদি
কেউ কোরআনের ন্যূনতম একটি আয়াতের অর্থ পড়ে এবং সঙ্গে এর ব্যাখ্যা পড়ে তাহলে
জীবন অনেক সহজ হয়ে যাবে। পড়ার পর কোনো বিষয়ে সন্দেহ হলে কোনো আলেমের কাছ
থেকে জেনে নিতে হবে। তাতেও সন্তুষ্টি না মিললে বিভিন্ন তাফসিরে তার উত্তর
পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ্। এরপর রয়েছে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু
আলাইহে ওয়া সাল্লামের হাদিস। প্রতিদিন অন্তত একটি করে হাদিস পড়লেই নিজের
পরিবর্তন বোঝা যাবে। আর হাদিসের হক হলো নিজে পড়া বা শোনার পর অন্যের কাছে
তা বর্ণনা করা। এই হাদিস বর্ণনা করার ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে
যেন একটি শব্দও নিজ থেকে বলা না হয়। হজরত সালামা ইবন আকওয়া (র.) বলেছেন,
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার নামে এমন
কথা বলবে যা আমি বলিনি, তার ঠিকানা দোজখে হবে। বোখারি, প্রথম খণ্ড, হাদিস
নম্বর-৮৭।
কোরআনের একটি কথা আপনার ভালো লাগলো বা আপনি কোনো উপকার
পেলেন সঙ্গে সঙ্গে তা অন্যকে জানিয়ে দিন তাতে আপনার দাওয়াতের কাজটাও হয়ে
গেলো। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে এই
আদেশ করেছিলেন, উপস্থিতগণ অনুপস্থিতগণকে আমার আদর্শ ও শিক্ষা অবশ্যই পৌঁছে
দিও।
দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁর অন্তিম সময়ের
এক ভাষণে বলেছেন, তোমরা যদি ইসলামের শিক্ষা হতে বিরাগী হও তাহলে তোমাদের
দুনিয়ারও বিপর্যয় ঘটবে এবং পরস্পরের সৌহার্দ বিনষ্ট হবে।
হে
আল্লাহ, আমাদের সবাইকে এক হওয়ার তৌফিক দান করুন। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি থেকে
মহান আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করার তৌফিক দান
করুন এবং কোরআন বুঝে পড়ার তৌফিক দান করুন। নিয়মিত অন্তত একটি হাদিস পড়ার
তৌফিক দান করুন। কোরআন হাদিসের আলোকে আমল করার তৌফিক দান করুন এবং ঈমানের
সঙ্গে মৃত্যু নসীব করুন, আমীন।
Collected By : Khan Rajib Hossain
No comments:
Post a Comment